Health issue

শহরের স্বাস্থ্য: মশা, পার্ক এবং বিনোদন

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা এর বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে একটি উদীয়মান মেগাসিটি সম্প্রতি এ শহরের জনসংখ্যা ৯০ লক্ষ ছাড়িয়েছে নগরায়ন ও শিল্পায়নের দ্রুত বর্ধনের কারণে এর ব্যবসা-বাণিজ্যেও এসেছে আধুনিকতা অর্থনৈতিক সেক্টরের পরিসর বৃদ্ধির সাথে সাথে অসংখ্য মানুষ ঢাকা শহরে চলে আসছেন কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনের খোঁজে 

কিন্তু, সম্ভাবনা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে বহুসংখ্যক সামাজিক সমস্যাও এসব সমস্যার মূল কারণ হলো অতিরিক্ত জনসংখ্যা, যার ক্রমবর্ধমান চাপ এ শহর নিতে পারছে না ফলে, মানুষের জীবন মান দিনদিন নিম্নমুখী হচ্ছে পরিবেশ দূষণ, বায়ু ও পানি দূষণ, যথাযথ পয়োঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থার অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ন- সব মিলিয়ে শহরের সার্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত বাজে এসবের মাঝেই, সম্প্রতি মশার সমস্যা পুনরায় উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে 

মশাভীতি বর্তমানে ঢাকার একটি বড় সমস্যা এ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শহরের জনস্বাস্থ্যও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ম্যালেরিয়ার মতো রোগব্যাধী মূলত স্ত্রী মশা এদের প্রজননের জন্য মানুষের রক্তপান করে থাকে

  • বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে স্ত্রী মশার তুলনায় পুরষ মশা অনেক কম। স্ত্রী মশার সংখ্যা মোট মশার ৭৭.৬% যেখানে পুরুষ মশার সংখ্যা ২২.৪%।
  • বর্তমান বিশ্বে ৩ হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে যার মাত্র ১১৩টি প্রজাতি বাংলাদেশে দেখা যায়।
  • বর্ষাকাল হলো এডিস মশার প্রজননের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়। এ মশাই ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী ভাইরাস ছড়ায়। ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিস’ তথা ডিজিএইচএসের গবেষকরা বলছেন, তারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৫টি ওয়ার্ডে এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৭টি ওয়ার্ডে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অধিক এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন।
  • ডিজিএইচএসের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৪৮৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মাঝে ২ জন মৃত্যুবরণ করেন। অথচ, পরবর্তী ২ দিনেই আরো অন্তত ৭২ জন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। গতবছর এ সময় মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২৮, আর মৃতের সংখ্যা ছিল ৩।
  • ২০১৭ সালে প্রাণঘাতী চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায় ঢাকায়। ‘ইনস্টিটিউট অব ইপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ’ তথা আইইডিচিআর এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৩,৮১৪ জন মানুষ এ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল।

অপরিষ্কার পুকুর, গর্ত, নর্দমা, খাল ইত্যাদির মতো নোংরা জলাশয়ই এসব মশার প্রধান প্রজননস্থল। যেকোনো স্থানে নোংরা পানি জমা মানেই মশার জন্য একটি প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হওয়া। জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনর আওতাধীন সর্বমোট ২৭০০ বিঘা পরিমাণ জমি রয়েছে যেখানে ময়লা-আবর্জনা এবং নোংরা পানি জমে আছে। মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মীরহাজিরবাগ, কামরাঙ্গিচর, মান্দা, মুগদা, গোরান, কাঠালবাগান, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, বনানীর মতো এলাকার বাসিন্দারা এ সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। গত দুবছরে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে মশার কয়েল, অ্যারোসোল কিংবা মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়েও পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, উভয় সিটি কর্পোরেশনেই এ সমস্যা কমবেশি আছে। তবে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দারাই এই সমস্যায় বেশি ভুগছেন।

গতবছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৯৪০টি মশা মারার যন্ত্র আছে যার মাঝে-

  • ৪৪২ টি হস্তচালিত, যার মাঝে আবার ২১৮ টি অকেজো।
  • ৪৪৭টি ফগার (ধোঁয়া দেয়ার যন্ত্র), যেগুলোর মাঝে ১৮৬টি সম্পূর্ণ অকেজো।
  • ৫১টি ঠেলাগাড়ি চালিত যন্ত্র, যেগুলোর মাঝে কেবল ১৬টি আংশিকভাবে কাজ করে।

অন্যদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনর রয়েছে মোট ৬৫৩টি যন্ত্র, যার মাঝে অর্ধেকই কাজ করে না।
মিরপুর ১১’র বাসিন্দা আমেনা আক্তার এ ব্যাপারে বলেন, “সম্প্রতি মশার সমস্যা প্রচুর বেড়েছে। কয়েল আর স্প্রে ছাড়া ঘরে থাকাই দায়। আবার, আমি সর্বক্ষণ এসব (কয়েল বা স্প্রে) ব্যবহারও করতে পারছি না। কেননা, এতে আমার ছোট বাচ্চাদের ক্ষতি হতে পারে।” বাসাবোর আরেক বাসিন্দা কাওসার আহমেন জানান যে তিনি গত কয়েক মাসে তার এলাকায় মশা নিধনের কোনো প্রচেষ্টাই লক্ষ করেননি। তিনি বলেন, “গত বছর মধ্যভাগে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ এই এলাকায় নিয়মিত মশা নিধনের জন্য কীটনাশক ছিটিয়েছে। কিন্তু গত ৭-৮ মাসের মধ্যে আমি অত্র এলাকায় কোনো মশা মারার ফগার দেখিনি।”


এদিকে, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও অবস্থা তেমন ভালো নয়। যদিও ডিএসসিসি প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে এই সমস্যা সমাধানে, তথাপি অনিয়মিত পর্যবেক্ষণের কারণে মশার সংখ্যা বৃদ্ধিই পাচ্ছে। টিকাটুলির অধিবাসী আয়েশা আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, “আজকাল আমাদের এলাকায় মশার উপদ্রব প্রচুর বেড়ে গেছে। সমস্যা এতটাই প্রকট যে আমরা মশারী ছাড়া ঘুমানোর কথা চিন্তাও করতে পারি না।”


দুই সিটি কর্পোরেশন এরকম ভিন্নতার কারণ হলো সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেট।

  • ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিএনসিসির মশক নিধন বাজেট ছিল ২০ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ২১ কোটি টাকা।
  • ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিএসসিসির মশক নিধন বাজেট ছিল ২৫.৬০ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ২৬ কোটি টাকা।

ইতোপূর্বে দুই সিটি কর্পোরেশনই মশার সমস্যা নিরসনে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এগুলো একনজরে দেখে নেয়া যাক-

  • ডিএসসিসির কর্মকর্তারা ৫০ হাজারের অধিক বাসাবাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে গিয়েছিলেন এডিস মশা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করতে।
  • সরকারের ‘প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইং’ বা পিপিটি ‘ইনফেক্ট উলবাচিয়া ট্রান্সফেকশন’ নামক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, যে সকল স্থানে এডিস মশা ডিম পাড়ে, সেখানে ব্যাকটেরিয়া স্থাপনের মাধ্যমে এডিস মশার সংখ্যা কমিয়ে আনা। এই ব্যাকটেরায় গুলো ভিন্ন প্রজাতির মশা উৎপাদন করে যা এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করে।
  • ডিএনসিসিও মশানিধনে উদ্যোগ নিয়েছে। ডিএনসিসি বাসাবাড়িতে কীটনাশক স্প্রে করছে, এডিস মশার লার্ভা জন্মাতে পারে এমন স্থানে লার্ভা নিধনকারী কীটনাশক ছিটাচ্ছে আর পরিষ্কার জলাশয়ে কচুরিপানা স্থাপন করছে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে।
  • দুটি সিটি কর্পোরেশনই প্রতি ওয়ার্ডে ৫ থেকে ৬ জন করে নিয়োগ করেছে মশা নিধনের ওষুধ ছিটাতে।

 

কিন্তু, বর্তমানে মশক নিধনের কীটনাশক স্প্রে করার পুনরাবৃত্তি কমে যাওয়ায় এবং কীটনাশকের মান পড়ে যাওয়ায় এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। উভয় সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে যে তারা ত্রুটিপূর্ণ ওষুধ ব্যবহার করছে। সিটি কর্পোরেশন আবার এজন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের অপ্রতুলতাকে দায়ী করছে।
যাহোক, প্রশাসন এ ব্যাপারে অবগত আছে। প্রশাসন স্বীকার করেছে যে দুই সিটি কর্পোরেশনের যৌথ পর্যবেক্ষণ ও উদ্যোগের অভাবই আজকের ব্যর্থতার কারণ। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, “মশক নিধনের জন্য আমরা ক্র্যাশ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করবো এবং আসছে বর্ষার আগেই নর্দমাগুলো পরিষ্কার করবো। মশক সমস্যা নিরসনে প্রশাসন এবং কাউন্সিলরগণ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।”
তিনি আরো বলেন, “আমি কাউন্সিলরদের বলেছি তারা যেন আমাকে সমস্যা সমাধানে লিখিত পরামর্শ দেয়। আগামী সাত দিনের মাঝেই আমরা নর্দমাগুলোর সংস্কার কাজ করে ফেলবো। কর্মীদেরও তাদের নিজ নিজ কাজ সঠিকভাবে করতে হবে।”
কর্তৃপক্ষ যখন সমস্যা নিরসনে নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে চলেছে, সাধারণ জনগণেরও উচিত সমস্যার সমাধানকল্পে কিছু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়া। জনগণকে অবশ্যই তাদের বাগান এবং বাড়ির ছাদসহ যেসব স্থানে মশা প্রজনন করে সেসব স্থান পরিষ্কারে সচেতন হতে হবে। উভয় পক্ষের মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

যাই হোক, শহরের সার্বিক স্বাস্থ্য কেবল শারীরিক সুস্থতা দিয়েই যাচাই করা যায় না। শহরবাসীর মানসিক অবস্থাও বিবেচনায় আনতে হবে। বিনোদন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই পার্ক, খেলাধুলার মাঠের ব্যবস্থা করে শহরবাসীর বিনোদনের সুযোগ করে দেয়া শহরেরই দায়িত্ব। বলা হয়ে থাকে, “অতিরিক্ত কাজ মানুষকে নিষ্প্রাণ করে দেয়।” একথা সকলের জন্যই সত্য। ক্লাস আর কাজের চাপে জীবন হয়ে যায় একঘেয়ে। তাই, চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে মানসিক চাপ শিথিল করা জরুরি।


গাড়ির অবিরত ভেঁপুর কর্কশ ধ্বনির শব্দদূষণ, ইঞ্জিনের ভয়ানক কালো ধোঁয়া আর প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ততা, সব মিলিয়ে শহুরে জীবন হয়ে ওঠে নীরস, যা থেকে পালানোর পথ করে দেয় বিনোদন। মানুষের এই কর্মব্যস্ততা থেকে বিরতি প্রয়োজন, এমন কিছু প্রয়োজন যা মনকে সতেজ করে, চাপ থেকে মুক্তি দেয়। খোলামেলা পার্কের চেয়ে বেশি প্রশান্তি আর কোনো স্থান এনে দিতে পারে না, যেখানে মানুষ সবুজ গাছের ছায়াতলে কিছু সময় শান্ত হয়ে বসতে পারে, বিশ্রাম করত পারে; খোলা মাঠ, যেখানে শিশুরা মুক্ত আকাশের নীচে অবাধে খেলতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে, দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান শিল্পায়ন আর আধুনিক প্রযুক্তির আগমনে পার্ক আর খেলার মাঠের মতো খোলামেলা স্থান বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে,

  • ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে সর্বমোট ৬০টি খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে। এগুলোর মাঝে আবার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে আছে। পার্কের সংখ্যা মোট ৪৭টি, আর খেলার মাঠ মাত্র ১৩টি।
  • শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্কগুলোর মধ্যে আছে রমনা পার্ক, ধানমণ্ডি পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, শিশু পার্ক, গুলশান লেক পার্ক আর ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন। এছাড়াও, শ্যামলীতে ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ আর বসুন্ধরায় ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’ এর মতো চিত্তবিনোদনমূলক পার্কও রয়েছে।
  • ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পার্কগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়।

উপরে উল্লিখিত পার্কগুলোতে সাধারণ মধ্যবয়স্ক নারী-পুরুষের যাতায়াত বেশি যারা ভোরবেলা সেখানে ব্যায়াম করতে যান। দিনের অন্যান্য সময়ে পার্কগুলোতে তরুণ তরুণীদের যাতায়াত বেশি। এদের একটা বড় অংশই শিক্ষার্থী। কেউবা উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়ায়, কেউ জগিং করতে থাকে, আবার কেউ বেঞ্চগুলোতে বসে পরিচিত জনের সাথে কথা বলে সময় কাটায়। ফেরিওয়ালারা নানারকম খাবার যেমন- ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, বাদাম, ইত্যাদি ছোট ছোট দু চাকার গাড়িতে করে বিক্রি করেন। তাছাড়া, ভিক্ষুকদের আনাগোনা আর হিজরাদের বিশ্রামরত মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলাও পার্কগুলোর পরিচিত দৃশ্য।

শিল্পায়নের দ্রুত বৃদ্ধিতে খালি জায়গা একেবারেই কমে গেছে, অবনতি হয়েছে পার্কগুলোর সার্বিক অবস্থারও। অধিকাংশ খোলা জায়গাই এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কিংবা সরকারি হলেও সরকার সেখানে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করছে। আবার, বিদ্যমান পার্কগুলোর মধ্যেও অনেকগুলোতে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। যেগুলো খোলা আছে, সেগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ। পর্যাপ্ত বসার জায়গা নেই, রাতের বেলা যথেষ্ট আলো নেই, ময়লা ফেলার ডাস্টবিনের সংখ্যাও অপ্রতুল। এছাড়াও, পুরো পার্কজুড়ে ময়লা ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আর রাস্তার ধোঁয়া, খোলা নর্দমার দুর্গন্ধ পার্কের পরিবেশ দূষণ করে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবই এর পেছনে মূল কারণ।

এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো আধুনিক প্রযুক্তির কবলে একটি প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়া। বর্তমান প্রজন্ম স্মার্টফোনকেই বিনোদনের সর্বোত্তম মাধ্যম মনে করছে। মানুষ এখন আর মাঠে খেলতে যায় না, পার্কে কিংবা চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যায় না। বরং দিনভর উদাসভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্ক্রল করে চলে। এর বাইরে বিনোদন বলতে রয়েছে টিভি দেখা আর কম্পিউটারে গেম খেলা। আর যেহেতু এসব বিনোদনে খুব একটা কিংবা একেবারেই কোনো শারীরিক নড়াচড়া বা ব্যায়ামের প্রয়োজন হয় না, তাই এগুলো উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করছে বেশি। আশার বিষয় হলো, এখনো অনেক কিশোর বিকালে মাঠে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলে। এটা সম্ভব হয় এলাকায় মাঠের উপস্থিতির কারণে।
পার্কে ঘুরতে যাবার ব্যাপারটা দিনকে দিন মানুষের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বরং মোবাইলের স্ক্রিনে স্ক্রল করে কিংবা ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে পছন্দ করছে। আর এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকই বলা চলে যেহেতু ঢাকায় পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। তবে, এর ফলাফল কিন্তু ভয়াবহ।

  • স্থূলতা এবং অন্যান্য রোগ
    আজকের তরুণ প্রজন্ম ঘরের বাইরে যথেষ্ট চিত্তবিনোদনের সুযোগ না পেয়ে বন্ধুবান্ধবের সাথে রেস্তোরাঁ আর ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেয়। অথবা ঘরে বসে একত্রে ভিডিও গেম খেলতে পছন্দ করে তারা। কিন্তু, নিয়মিত শারীরিক নড়াচড়ার অভাবে তাদের স্থূলতাসহ অন্যান্য কার্ডিওভাস্কুলার জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।
  • স্নায়বিক সমস্যা
    নিয়মিত শরীরচর্চার অভাবে নানাবিধ স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে। যেমন- মনোযোগহীনতা, বিষণ্ণতা ইত্যাদি। তাছাড়া, ইলেকট্রিক স্ক্রিনে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকার কারণে চোখের দৃষ্টিক্ষমতা সংক্রান্ত নানা জটিলতাও হয়ে থাকে।
  • বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ
    পার্কসহ অন্যান্য খোলা স্থানগুলো মানুষকে শরীরচর্চা ও অবাধ চলাফেরার সুযোগ করে দেয় যা শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য জরুরি। পর্যাপ্ত বিনোদনের সুযোগ না থাকায় মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে, উদ্বেগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ মাদকাসক্তি ও অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।

‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ’ এর এক রিপোর্ট অনুসারে ঢাকা শহরের অধিকাংশ খোলা জায়গা সরকারি কোনো এজেন্সি অথবা বেসরকারি কোনো সংস্থার দখলে রয়েছে, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ৩৭৪ জন মানুষের উপর করা এক জরিপে দেখা যায় যে ৬০ ভাগ মানুষ নিকট অতীতে কোনো পার্কে গিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রতি ৫ জনের ২ জন, অর্থাৎ ৩৯ ভাগ মানুষ কখনোই যাননি। এই জরিপ প্রমাণ করে ঢাকায় পর্যাপ্ত পার্কের অভাব কতটা প্রকট।


ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনপ্রতি ০.০৫২ বর্গমিটার পার্ক এবং ০.৫ বর্গমিটার খোলা স্থান রাখার সুপারিশ রয়েছে। অথচ, ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ (ডব্লিউএইচও) এবং ‘লিডারশীপ ইন এনার্জি এনভায়রনমেন্টাল ফর নেইবারহুড ডিজাইন’ এর সুপারিশ অনুযায়ী পার্ক এবং উন্মুক্ত স্থান যথাক্রমে ৯ এবং ২০ বর্গমিটার হওয়া উচিত। যদিও সরকার ২০০০ সালের দিকে খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, প্রাকৃতিক জলাশয় আর পার্কগুলো সংরক্ষণের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেছিল, আইনটি কাজে লাগানো হয়নি বললেই চলে। তাছাড়া, রাজধানী ঢাকার জন্য করা বহুল আলোচিত মাস্টার প্ল্যানে এখানকার পার্ক এবং প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোকে পুনরায় উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়নে উদাসীন।
উপরন্তু, ঢাকার পার্কগুলো প্রচুর কোলাহলপূর্ণ। এগুলোতে যথেষ্ট বসার জায়গা নেই, পানির সরবরাহ নেই, ময়লা ফেলার ব্যবস্থা নেই, নেই পর্যাপ্ত পয়োনিঃষ্কান কিংবা হাঁটার ব্যবস্থাও।

এসব খাতে সরকারের নজরদারি এবং বিনিয়োগই পারে মানুষকে পুনরায় পার্কমুখী করতে। তাছাড়া, শহরের মানুষ নানা ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে যেগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সচেতন হতে হবে। যদি এখানে যথেষ্ট পরিমাণ টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, ইত্যাদির মতো অন্যান্য আউটডোর বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তরুণ প্রজন্ম বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে সেখানে অধিক সময় কাটাতে পারতো এবং বিপথে যাবার সুযোগ পেত না। এতে করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হতো এবং শরীর ও মনের মাঝে ভারসাম্য আসতো। অধিক খোলা জায়গা থাকলে মানুষ অধিক কর্মঠ হয়ে ওঠে। কারণ মানুষ তখন অবাধে চলাফেরা করতে পারে, জগিং করতে পারে, শিশুরা ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলাধুলা করতে পারে। ফলে মানুষ ব্যক্তিজীবনের চাপ থেকে মুক্ত হয়ে জীবনকে অধিক উপভোগ করতে পারে।


একটি শহরের স্বাস্থ্য এর বাসিন্দাদের শারীরিক এবং মানসিক, উভয় স্বাস্থ্যের উপরই নির্ভর করে। মশক সমস্যার নিরসন না হলে মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর যথেষ্ট বিনোদনের ব্যবস্থা করা ছাড়া মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষাও সম্ভব নয়। আর, কেবল শহরের মানুষের মানসম্মত জীবন নিশ্চিত করলেই শহরের উন্নয়ন সম্ভব, অভূতপূর্ব সব পরিবর্তন সম্ভব।

কৌতূহলোদ্দীপক প্রাসঙ্গিক বিষয়
বাংলাদেশ বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হবার পথে হাঁটছে। এটি পুরো বিশ্বেরই সমস্যা। অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সেগুলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদেহে কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন- পবা’র মতে, রোগীদেরকে পথ্য হিসেবে দেয়া ৫৬ ভাগ অ্যান্টিবায়োটিকই এখন আর কাজ করছে না। অবারিত অ্যান্টিবায়োটিক ডোজ ব্যবহার, খাদ্যের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া পোল্ট্রি আর মাছ ভক্ষণ- সব মিলিয়ে আমাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সায়েদুর রহমান বলেন, “মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার, ঔষুধ বিক্রেতাদের অসচেতনতা, দুর্বল নজরদারি ব্যবস্থা এবং যথেষ্ট স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যের অভাবই ‘অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’ (এএমআর) সমস্যা বৃদ্ধি করছে।”

অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে কাজ না করলে ব্যাকটেরিয়াগুলো বিবর্তিত হবে এবং নিজেদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে না। তাই, এ সমস্যা নিরসনের পথ দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায়, ২০৫০ সালের মধ্যে এএমআর এতো বৃদ্ধি পাবে যে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটবে।